মো. নবী আলম: বটবৃক্ষ আমাদের ছায়া দেয়, অক্সিজেন দেয়। এর ছায়াতলে বসে নির্মল বাতাসে পথিক ক্লান্তি দূর করে। যতদিন বেঁচে থাকে মাথার ওপর ছাতার মতো দাঁড়িয়ে নিঃস্বার্থভাবে সেবা দেয়। বাংলার প্রায় প্রতিটি গ্রামে বটবৃক্ষ দেখা যায়। বটবৃক্ষের নীচে গ্রামের মানুষ হরেক রকমের মেলা ও হাটবাজারের আয়োজন করে। নানা ধরণের মানুষ সেখানে আসে। কেউ কেউ গানবাজনা করে। দিন শেষে আবার কেউ দুষ্টুমির ছলে ডাল-পালা ভেঙে নিয়ে যায়। তবুও বটবৃক্ষ ছায়াতল থেকে কাউকে বঞ্চিত করে না। বটবৃক্ষ যতদিন বেঁচে থাকে মানুষ তার মর্ম বুঝে না। মরে গেলে হায় হায় করে। অভাব অনুভব করে।
আমাদের প্রতিটি সংসারে বটবৃক্ষ রয়েছে। যিনি দিন-রাত সংসারের সুখ-শান্তির জন্য নিরলসভাবে পরিশ্রম করেন। তিনি হলেন আমাদের জন্মদাতা পিতা। অনেকে বাবাও বলে থাকি। প্রত্যেক ছেলে-মেয়ের কাছে প্রতিটি বাবা-ই সেরা বাবা। বাবা বুক দিয়ে তাঁর সন্তানদের আগলে রাখেন, যাতে ফুলের টোকাটিও গায়ে না লাগে। নিজে না খেয়ে সন্তানদের খাওয়ান। তবুও সন্তানকে নিজের কষ্ট বুঝতে দেন না।
তিন ভাই, দুই বোন, মা ও বাবা সাতজনের একটি সুখি পরিবার। পরিবার প্রধান ছিলেন বাবা। বাবা সরকারি চাকরি করতেন। পরিবারের আয় বলতে বাবার একমাত্র বেতন। যা দিয়ে সংসার চলতো। তখন সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন এত বেশি ছিল না। সামান্য বেতন পেতেন। তা দিয়ে সংসারের খরচ, ভাই-বোনদের লেখাপড়া ঠিকঠাক বাবা চালিয়ে নিতেন। বাবা নিজে কষ্ট করলেও আমাদের ভাই-বোনদের কখনো বুঝতে দিতেন না। বাবা আপাদমস্তক সৎ ও ভালো মানুষ ছিলেন। শুধু সৎ ও ভালো মানুষ বললে অতৃপ্তি থেকে যায়, তিনি উদার মনের দেশ প্রেমিক মানুষ ছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ছিলেন তাঁর প্রিয় মানুষ। যিনি সবসময় বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে ধারণ করতেন।
উনিশ শ একাত্তরে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রণ না করলেও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে বাবার অবদান ছিল। বাবা নিজ এলাকার হিন্দুদের পাকবাহিনী ও রাজাকারদের থেকে বাঁচাতে জীবন বাজি রেখে নিরাপদ স্থলে পৌঁছে দিয়েছেন। অনেক হিন্দু পরিবারকে ডর-ভয় উপেক্ষা করে বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন।
বাবা অসাম্প্রদায়িক ও সংস্কৃতিমনা ছিলেন। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে বাবার সুসম্পর্ক ছিল। গ্রামের ছোট-বড় সবাই বাবাকে ভালোবাসতেন, সম্মান ও শ্রদ্ধা করতেন। ছোটবেলায় বাবা গ্রামের বিভিন্ন পালাগান ও নাটকে অভিনয় করতেন।
বাবা যখন ছোট তখন দাদী মারা যান। দাদীর কোনো বোন ছিল না। শুধু দুই ভাই ছিল। উনারা অবস্থাশালী পরিবার ছিল। প্রভাবশালী পরিবার হিসেবে গ্রামে নাম ডাক ছিল। দাদীর মৃত্যুর পর বাবা ও তাঁর ভাই-বোন মামাদের বাড়ি থেকে লেখাপড়া করেন। দাদী মারা যাওয়ার সময় বাবার ছোট ভাই সানোয়ার হোসেন সানাল কাকার বয়স ২ কি ৩ বছর ছিল। বাবা তাঁর ছোট ভাইকে খুব ভালোবাসতেন। বলা যায়, কাকাকে পিতৃস্নেহে বড় করেছেন।
ঈদ আসলে বাবা আমাদের ভাই-বোনদের নতুন শার্ট, প্যান্ট ও জামা-কাপড় কিনে দিতেন। আমার বয়স যখন ৬ কি ৭ বছর, তখন বাবা কোনো এক রোজার ঈদে নতুন শার্ট, প্যান্ট ও জামা-কাপড় কিনতে ঢাকা গিয়েছিলেন। ভাই-বোন সবাই অপেক্ষায় ছিলাম বাবা কখন আসবেন। বাবার আসতে রাত হয়ে গিয়েছিল। অপেক্ষা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছিলাম টের পাইনি। বাবা ঘুম থেকে ডেকে তুলে আমার হাতে গাঢ় নীল রঙের একটি শার্ট দিলেন। আমি তো অবাক। নীল আমার খুব-ই প্রিয় রঙ। পছন্দের রঙের শার্ট পেয়ে আনন্দের যে ঝড় উঠেছিল, মনে তা আজও গেঁথে আছে।
আশির দশকের মাঝামাঝি কোরবানি ঈদের দশ-বারো দিন আগে বাবা হাট থেকে একটি ছাগল কিনে আনেন। ছাগলটির রঙ কালো, দেখতে বেশ সুন্দর। ছাগল পেয়ে আমরা সবাই খুশি। ভাই-বোনেরা সবাই মিলে ছাগলের যত্ন ও আদর করা শুরু করে দিলাম। ছাগলের জন্য ঘাস কাটতে হবে, কাঁচি কোথায়। কীভাবে ঘাস কাটবো। বাবাকে বলার সঙ্গে সঙ্গে বাজার থেকে কাঁচি কিনে আনলেন। আমরা তো কখনো কাঁচি দিয়ে ঘাস কাটেনি, বাবা আমাদের দেখিয়ে দিলেন কীভাবে কাটতে হয়। ঈদের দিন নামাজ শেষে ছাগলটি কোরবানি করা হলো। বাবা সিঁড়ির ও আশপাশের মানুষকে অল্প অল্প করে মাংস দিলেন। মা রান্না করলেন। দুপুরে সবাই বাবার সাথে বসে তৃপ্তিসহ খেলাম।
ঈদের দিন রাতে টিভিতে জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান আনন্দ মেলা প্রচারিত হতো। আশি-নববই দশকে এখনকার মতো ঘরে ঘরে টিভি ছিল না। কদাচিৎ হাতে গোনা কয়েকটি বাসায় ছিল, তাও সাদা-কালো। রাতে মানুষের বাসায় গিয়ে টিভি দেখতে হয়, বাবার সেটা পছন্দ ছিল না। তাই বাবা নব্বই দশকের শুরুর দিকে সাদা-কালো ১৭ ইঞ্চি নিপ্পন টিভি কিনে আনেন। স্মৃতি হিসেবে আজও আমার বাসায় টিভিটি আছে।
একবার বাসার সবাই গ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে গিয়েছিল। আমি যায়নি। কারণ গ্রামে ঈদ আমার ভালো লাগতো না। আমার জন্য বাবার যাওয়া হলো না। বাসায় থেকে গেলেন। ঈদের আগের দিন বাবা বাজার থেকে মাংস, সেমাই, পোলাও ও খিচুরির চাল কিনে আনলেন। আমি দেখে অবাক হলাম। বাবা এগুলো আনলেন, কিন্তু রান্না করবে কে? আমি তো রান্না করতে পারি না। বাবাকেও কখনো রান্না করতে দেখি নাই। রাতে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে ঘুম থেকে ওঠে দেখি বাবা সেমাই, খিচুরি ও মাংস রান্না করে টেবিলে সাজিয়ে রেখেছেন। আমাকে বললেন, গোসল করে রেডি হও, সেমাই খেয়ে ঈদগাহে নামাজ পড়তে যাব। গোসল শেষে রেডি হয়ে খাবার টেবিলে বাবার সাথে সেমাই খেতে বসলাম। সেমাই মুখে দিতেই সুস্বাদু ঘ্রাণ ও যে স্বাদ পেলাম যা কখনো ভুলার নয়। বাবা এত মজা করে রান্না করতে পারে বাড়িতে গেলে হয়তো তা জীবনেও জানতে পারতাম না।
জ্ঞান হওয়ার পর বাবাকে ছাড়া একটি ঈদও করিনি। প্রতিটি ঈদে বাবার সাথে নামাজ পড়তে ঈদগাহে গিয়েছি। নামাজ শেষে বাবা আমাদের রঙিন বেলুন, বাঁশি, প্লাস্টিকের গাড়ি, কাঠের বন্দুক কিনে দিতেন। আজ বাইশ বছর হলো বটবৃক্ষ বাবাকে ছাড়া ঈদ উদযাপন করি। বাবা পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে আমাদের ছেড়ে ২ হাজার সালের ১৩ আগস্ট চিরকালের জন্য পরপারে চলে যান। ওই বছর ২৮ ডিসেম্বর বাবাকে ছাড়া প্রথম ঈদ, যা ছিল বটবৃক্ষ ছাড়া শূন্যতায় ভরা ঈদ। নামাজ শেষে সব ভাই বাসায় ফিরে কান্নায় ভেঙে পড়ি। আমার বড় ভাই সবচেয়ে বেশি ভেঙে পড়েন। কারণ মৃত্যুর সময় বাবাকে শেষ দেখাটাও তিনি দেখতে পারেন নাই।
বাবা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমাদের ভাই-বোনদের বটবৃক্ষের মতো আগলে রেখেছেন। কখনো অভাব, দুঃখ, কষ্ট অনুভব করতে দেননি। বাবা একটু রাগী ছিলেন বটে। কঠোর শাসন করতেন। তাই বলে ভালোবাসার কোনো কমতি ছিল না। আজও ঈদ উদযাপন করি, সন্তানদের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করি। তারপরও বাবার শূন্যতা অনুভব করি, যা কখনো পূরণ হবার নয়।
– মো. নবী আলম
উন্নয়ন কর্মী ও সাংবাদিক