মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী ২০২৫, ১২:৩৯ অপরাহ্ন

সেকেলের হজ্জ

রিপোটারের নাম / ২৯৮ বার এই সংবাদটি পড়া হয়েছে
প্রকাশের সময় : শুক্রবার, ৮ জুলাই, ২০২২

আহমাদ ফাহাদ: হৃদয় ভরা আশা আর চোখ ভরা স্বপ্ন হজ্জের যাত্রাটা সময়ের এই প্রবাহ ধারায় যতটা সহজ, পূর্বে তা কখনোই ছিলনা। শত বাধাবিপত্তি আর দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে অতঃপর হজে শামিল হতেন বায়তুল্লাহর মুসাফিরেরা। কেমন ছিল তখনকার হজযাত্রা? কালো গিলাফের কাফেলা?

চলমান সময়ের থেকে মাত্র কয়েক দশক আগেও উপমহাদেশীয় মুসলমানদের হজ করে হাজি হওয়াটা ছিল মহাযুদ্ধে জয় লাভের ন্যায়। শারীরিক সামর্থ্য, দৃঢ় মনোবল আর যথেষ্ট সম্পদ থাকার পরও চ্যালেঞ্জ হয়ে থাকতো যাতায়াত ব্যবস্থা। হজ্জ করে যিনি ফিরতে পারতেন আপন ঘরে, তিনি তো ছিলেন বীর। মহাবীর!

একটা সময় হজ্জ করার জন্য শুধু মাত্র দুটি উপায় ছিল। এক. স্থলপথ। দুই. জলপদ। স্থলপথে আফগান, ইরান, ইরাক হয়ে এরপর হজ্জে যেতে হতো। সেখানেও থাকতো কঠিন বাঁধা। ডাকাতের হানা অথবা ভীনধর্মীদের আক্রমন। অপর রাস্তা ছিল জলপদ। যেখানে পাড়ি দিতে হতো লোহিত সাগর। একেতো সমুদ্রভীতি অন্যদিকে জলদস্যুর কবলে পড়ার শংকা। তখনকার সময় পর্তুগিজ ডাকাতের উৎপাত ছিল ভীষণ। যদিও পরবর্তিকালে সম্রাট আকবরের শাসনামলে সম্রাট নিজে পর্তুগিজদের সাথে চুক্তি করেন এবং হাজিদের বিপদ মুক্ত করেন। সেসময় তিনি তিনটি আলাদা জাহাজও রাখেন হাজিদের জন্য। সাথে একজন আমীরে হজ্জ নির্ধারণ করে মক্কা-মদিনার জন্য ছয় লক্ষ রুপি উপঢৌকনও পাঠান। এবং এ ধারা চলমান থাকে সম্রাট আওরঙ্গজেব পর্যন্ত।

সতের শতকে হাজিদের বন্দর ছিল গুজরাটের সুরাট, যা বাবে আল মক্কা নামেও পরিচিত ছিল। উনিশ শতকের দিকে হজযাত্রীদের মুম্বাই পৌঁছাতে হতো মহিষের গাড়ি বা নৌকাতে চড়ে। এতে বন্দরে পৌঁছাতে পৌঁছাতে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়তেন, কেউবা পথে দেরি অথবা পথ ভুল করায় জাহাজ ধরতে পারতেন না। তবু তারা মাসের পর মাস বন্দরে অপেক্ষা করতেন হজফেরত যাত্রীদের জন্য। তাঁদের দেখে আর তাঁদের মুখের গল্প শুনেই মনের কষ্ট লাঘব করার চেষ্টা করতেন। বাড়ি ফিরে তাঁরা হতেন ‘মুম্বাই ফেরত হাজি!’

সমুদ্রের ঝড়ঝাপটা আর ভয়ংকর অভিজ্ঞতা নিয়ে হাজিরা মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিতেন কিছুদিন। তখন বিভিন্ন ছোঁয়াছে রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যেতেন বহু হজ্জযাত্রী। একবুক লালিত স্বপ্নের কবর রচিত করে তবু কাফেলা এগিয়ে যেতো মাঞ্জিলের দিকে। ‘লক্ষ’ অটুট! অবিচল!

জেদ্দা পৌঁছানোর পর হাজিদের শুরু হতো তালবিয়া পাঠ। ইহরামের কাপড় শরীরে জুড়ে সিক্ত হতেন আনন্দের অশ্রুতে। আহা! এ বুঝি আমেনার দুলালের শহর! এ বুঝি কা’বার সামীয়ানা!

জেদ্দা শহর হতে তৈরি হতো বড় বড় কাফেলা। কোন কোন কাফেলায় এক হাজার মানুষও থাকতেন। হাতে সময় বেশি থাকলে রওনা দিতেন মদিনায়, সেখান থেকে যেতেন মক্কায়। আর হজের সময় স্বল্প হলে সরাসরি চলে যেতেন মক্কার পথে। সেখানেও থাকতো মরুঝড়, আরব বেদুইনদের আক্রমণ। বলতে গেলে এ যেন এক অগ্নিপরিক্ষা!

এতো এতো প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে তবু মুসাফির যখন হাজির হতেন আসওয়াদের সামনে। সবুজ গম্বুজ যখন দৃশ্যমান হতো চোখের ললাটে। তখন কি আর থাকে জীবনের কোন শোক?

দুর্গম তিমির মুছে জীবনের পথে উদিত হয় লাল রবি। নতুন সূর্যদয়ের যাত্রায় শুরু হতো এক স্বচ্চ প্রভাত। স্বপ্নের বাগানে ফোটা ফুল হাতে নিয়ে আরবীদের মতো গায়ে জুব্বা, মাথায় পাগড়ি আর হাতে জমজমের পানি ও খেজুর নিয়ে বাড়ি ফিরতেন হাজিরা। এ যেন জীবনের স্বার্থকতা! শরীর জুড়ে রাজ্যের ক্লান্তি থাকলেও মন থাকত তৃপ্তিতে পূর্ণ।

হাজিদের অভ্যর্থনা জানাতে হাজির হতো পুরো গ্রাম। বড়-ছোট, যুবক-বৃদ্ধ, নারী-শিশু সবাই। হাজির হতো দূর দূরান্তের মানুষও। হজফেরত হাজি তিনি যেন বিজয়ী বীর! ভীন্নগ্রহের মানুষ। পৃথিবীর প্রতিটি সৃষ্টি যেন থমকে যেতো মূহুর্ত! বুকভরা ভালোবাসায় ধ্বনিত হতো ‘আহলান সাহলান!’

হয়ত বা জীবনের এমন ভয়ংকর সৌন্দর্য্য দেখে কেউ কেউ গেয়ে যেতেন স্বপ্নজয়ের গান—

ধন্য আমি, ধন্য জীবন,
ধন্য আমার মরণ
চাইনা গো আর কিছু ওরে!
তুচ্ছ এ ভূবণ।
এবার যদি ডাক আসে মোর,
ওপার যাবার ভাই!
হাসি মুখে পাড়ি দিবো,
বলবো তোদের বিদায়!


আপনার মতামত লিখুন :
এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ